১১ ডিসেম্বর, ২০২২
ছবি: শিল্পি আনিমা দের ছবি
যাত্রা মঞ্চ নাটক এবং কণ্ঠসঙ্গীতের একসময়ের কিংবদন্তি এক শিল্পীর নাম অনিমা দে। দরাজ অভিনয়ের মাধ্যমে আন্দোলিত করেছেন অনেকের হৃদয়। স্বামী দিলীপ কুমার দে তিনিও ছিলেন একজন বড় মাপের অভিনেতা । পিতা যোগেশচন্দ্র দে তিনি ছিলেন একজন বড় ওস্তাদ'। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আগরতলা থেকে চলে যান দার্জিলিং গৌহাটি শিলচর শিলং প্রভৃতি জায়গায় । মঞ্চ নাটক যাত্রাপালা কণ্ঠসঙ্গীত এর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় শো করে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ করছিলেন । বঙ্গবন্ধুকে অনেক দূর থেকে অনেকবারই দেখেছেন অনিমা দে কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলার মতো কখনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি । স্বাধীনতার পর 1972 সালে চট্টগ্রাম নেভি ক্লাবের সামনে নেভিদের উদ্যোগে নাটক চলতে থাকে । সেবার তিনি জয়দুর্গা অপেরাতে ছিলেন । মালিক ছিলেন কানাইলাল চক্রবর্তী । নেভি ক্লাবে নাটক চলাকালীন সময়ে হঠাৎ করে একদিন কানাইলাল চক্রবর্তী এসে শিল্পীদের সবাইকে বললেন বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে নাটক করতে হবে বাংলাদেশ বেতার ঢাকায় । শিল্পীরা শোনামাত্র মহা খুশি । অনিমা দে বললেন যাকে দূর থেকে এতবার দেখেছি সেই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে আমরা নাটক করবো এত স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি । মালিক কানাইলাল চক্রবর্তী শিল্পীদেরকে বলেন আগামী কালকে আমাদের রওনা দিতে হবে বাংলাদেশ বেতার ঢাকা তে । পরেরদিন নেভি ক্লাব থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল জয়দুর্গা অপেরা । বাংলাদেশ বেতার ঢাকা তে পৌঁছাতেই সেখানে দেখা হয়ে গেল পিত্র সমতুল্য বিশিষ্ট সুরকার গীতিকার বর্তমান মাইলস ব্যান্ডের শাফিন আহমেদের প্রয়াত পিতা কমল দাশগুপ্তের সাথে । দেখা হতেই কমল দাশগুপ্ত কে প্রণাম করেন অনিমা দে । কারণ অনিমা দের পিতা যোগেশচন্দ্র দে এবং কমল দাশগুপ্ত একই গুরুর শিষ্য ছিলেন । শুরু হলো এক মিলন মেলা । কমল দাশগুপ্ত বললেন আগামীকাল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তোমাদেরকে নাটক করতে হবে । ইতিমধ্যে সেখানে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু স্বয়ং হাজির হয়ে যান । বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্রই প্রণাম করেন অনিমা দে । বঙ্গবন্ধু বলেন তোমাদের গল্প আমি শুনেছি যাও বিশ্রাম সেরে তোমরা আগামীকালকে নাটকের জন্য প্রস্তুতি নাও আমি সম্পূর্ণ নাটক দেখব । পরেরদিন বাংলাদেশ বেতার ঢাকা এর ভিতরে মঞ্চস্থ করা হয় নাটকটি । মূলত নন্দ রানীর সংসার যাত্রাপালা টিকে বৌদি নামকরণ করে নাটক আকারে মঞ্চস্থ করা হয় । প্রায় সাড়ে সাতটা দিকে শুরু হয় নাটকটি । মঞ্চের প্রথম সারিতে সোফাতে বসা ছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং নিজে এবং বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক সেইসাথে কমল দাশগুপ্ত । সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বড় পর্দার মাধ্যমে প্রদর্শন করা হচ্ছিল নাটকটি সরাসরি বেতারের মধ্য থেকে । সেখানে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছিল ।শুধু তাই নয় সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত নাটকটি রিলে করা হয়েছিল । সবথেকে স্মরণীয় বিষয়টি হলো নাটকটি চলাকালীন সময়ের এক ঘন্টা পর মহাপরিচালক এসে বলেন সংক্ষিপ্ত করার জন্য কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেন আমি শেষ পর্যন্ত নাটকটি দেখে যাবো। চলতে থাকে নাটকটি । প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা যাবত একটানা বসে বঙ্গবন্ধু নাটকটি দেখেন এবং শিল্পীদের কে প্রশংসিত করেন সেইসাথে অনিমা দে কে ফুলের শুভেচ্ছা ও মেডেল প্রদান করেন ।বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক অনিমা দের স্বামী দিলীপ কুমার দে কে প্রিন্স উপাধিতে ভূষিত করেন । নাটক শেষে শিল্পীদের সাথে বঙ্গবন্ধু একসাথে খাওয়া দাওয়া করেন । তিনি অনিমা দের অনেক প্রশংসা করেন । কমল দাশগুপ্ত এবং অনিমা দে র পিতা যোগেশচন্দ্র দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন আর কবে দেখা হবে সেটাও তারা জানেন না । সেদিন কলকাতা থেকেও অনেকেই প্রশংসিত করেছেন শিল্পীদেরকে প্রশংসিত করেছেন শিল্পী অনিমা দে কে । বঙ্গবন্ধু বলেন আমি শিল্পীদের খুবই ভালোবাসি সংস্কৃতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে । পরেরদিন বেতার বাংলা নামে একটি স্মরণিকা ছোট আকারে প্রকাশিত হয় এবং সারা ঢাকা শহর সহ বাংলাদেশ ও ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে । সেই স্মরণিকা তে বঙ্গবন্ধু সহ শিল্পী অনিমা দের ছবি এবং অন্যান্য সকল শিল্পীর ছবি ও তথ্য-কণিকা গুলো ছিল । সময়ের স্রোতে অনিমা দের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে দুই দুইটি সন্তান । কিন্তু আজও সেই স্মরণিকার সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি ।কারণ সেটাতেই ছিল সকল তথ্য । অনিমা দে আরো বলেন বঙ্গবন্ধু সত্যি এক অসাধারণ মহামানব ছিলেন যিনি নিজের কথা কখনোই ভাববেন না । সব সময় তিনি ভেবেছেন সাধারণ মানুষের কথা ।তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন আমার অবস্থা এমন থাকতো না এটা দুর্ভাগ্যের পরিহাস । প্রায় বেশ কিছুদিন পূর্বে শাফিন আহমেদের মেসেঞ্জারে এই তথ্যের জন্য মেসেজ করেছেন তাকে কিন্তু কোন উত্তর আসেনি । বর্তমানে অনিমা দে মন্দিরে কীর্তন এর মাস্টারি করে জীবন যাপন করছেন । তিনি আজও ভুলতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতি । আজও খুঁজে চলেছেন বেতার বাংলা নামের সেই স্মরণিকা বা ছোট্ট ম্যাগাজিনটি কারণ সেটাতেই লিপিবদ্ধ আছে সকল তথ্য । সময়ের স্রোতে জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে গেলেও হারাইনি সেই স্মৃতির অনুসন্ধান ।স্বাধীনতার এত বছর পরে আজও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি খুঁজে চলেছেন শিল্পী অনিমা দে ।