১৫ Jun ২০২৫
হোম স্বাস্থ্য সারাদেশ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি ও বাণিজ্য খেলাধুলা বিনোদন আন্তর্জাতিক ধর্ম ও জীবন লাইফ স্টাইল শিক্ষা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পরিবেশ চাকরি বা ক্যারিয়ার মতামত আইন-আদালত কৃষি ও প্রযুক্তি বিশেষ সংবাদ অপরাধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বকাপ ফুটবল
অর্থনীতি ও বাণিজ্য

পর্যাপ্ত নথি ও জামানত ছাড়াই ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন

০৪ অক্টোবর, ২০২২

আব্দুল্লাহ হিল কাইয়ূম,
বার্তা সম্পাদক

ছবি: ব্যাংক সমূহ

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এ তিনটি বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ব্যাংক। অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের শরিয়াহভিত্তিক উক্ত তিন ব্যাংক উত্তরবঙ্গের কোম্পানি নাবিল গ্রুপকে পর্যাপ্ত নথি ও জামানত ছাড়াই ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।

উক্ত ব্যাংক তিনটি একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ যত টাকা ঋণ দেওয়া যায়, তার সীমাও লঙ্ঘন করেছে। তনমধ্যে ইসলামী ব্যাংক দিয়েছে সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দিয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এই ঋণ ঝুঁকি তৈরি করবে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ হতে পারে। ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো কতটা উদার ছিল, তা উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। গ্রুপের একটি কোম্পানির বর্তমাণ ঋণ আছে সাড়ে ৮ লাখ টাকা। সেই কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা আছে কিনা, সেটিও যাচাই করা হয়নি।

উক্ত বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। তিন ব্যাংকের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যাও চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ব্যাংক তিনটি সহজ শর্তে এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে? তবে ঋণ দেওয়ার অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলা হচ্ছে না। যদিও নাবিল গ্রুপ দাবি করেছে, তারা নিয়ম মেনেই ঋণ পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের কাছে এই সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যাও চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ব্যাংক তিনটি সহজ শর্তে এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে? এই কর্মকর্তা আরও জানান, এত বড় ঋণের পেছনে কোম্পানির পরিচালকদের হাত রয়েছে কিনা, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অপরদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন ঋণের এই বিষয়টিকে ‘খুবই খারাপ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই ব্যবসায় দেওয়া ঋণের পরিমাণ অনেক বড়। যারা এত বড় ঋণ নিয়েছে, তা পরিশোধের ইচ্ছা নাও থাকতে পারে কোম্পানিটির।

সিনিয়র এই ব্যাংকার আরও বলেন, বিশাল অঙ্কের এ ঋণ প্রক্রিয়ায় কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা। একটি নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কীভাবে তিন ব্যাংক থেকে এত বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে, তা খুঁজতে তদন্ত শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

চলতি বছরের ৫ জুন ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭০তম নির্বাহী কমিটির সভায় নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে বিতরণ করার জন্য ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়।

কোম্পানির সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৮ দশমিক ৫ লাখ টাকার এক্সপোজার ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম (আইসিআরআরএস) অনুযায়ী, কোম্পানিটি প্রান্তিক শ্রেণির (নতুন কোম্পানি) অন্তর্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক তার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য বলেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানির কাছ থেকে আমানত হিসেবে ১১০ কোটি টাকাসহ জামানত হিসেবে আইবিবিএলের অন্তত ২৩০ কোটি টাকা নেওয়া উচিত ছিল। সহজ শর্তে দেওয়া এসব ঋণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা চলতি বছরের জুনে নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডকে ৭০০ কোটি টাকাসহ নাবিল গ্রুপের বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে।

সভার কার্যবিবরণীতে ব্যাংক দাবি করেছে, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড এবং নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেড একই গ্রুপের কোম্পানি নয়। তবে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই নাবিল গ্রুপের বলে সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যদি ওই দুই প্রতিষ্ঠান একই গ্রুপভুক্ত হয় তাহলে ইসলামী ব্যাংক একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করবে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

চলতি বছরের ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) ৪৮১তম বোর্ড সভায় নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড, নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা (তহবিলযুক্ত এবং নন-ফান্ডেড উভয়) ঋণ অনুমোদন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসআইবিএল নাবিল গ্রুপের ঋণ অনুমোদনের জন্য তার নিয়ম এবং শর্ত শিথিল করেছে। এ জন্য এর দেওয়া ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ।

এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানান, তিনটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের বেশিরভাগ পরিচালক চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী পরিবারের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহ, এই পরিচালকরা নাবিল গ্রুপের সহজ শর্তে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ার সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণদাতা এলসি কমিশন কমিয়েছে এবং জামানত ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টি জমা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসআইবিএল এই ঋণগ্রহীতা ক্লায়েন্টকে কোনো ধরনের বেআইনি সুবিধা দিচ্ছে কিনা এবং কোম্পানিটি এ ব্যাংকের কোনো পরিচালকের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান কিনা, তা খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

চলতি বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এফএসআইবিএল) ২৪৬তম বোর্ড সভায় নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড, নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা (তহবিলযুক্ত এবং নন-ফান্ডেড) ঋণ অনুমোদন করেছে।

কোম্পানিগুলোকে কেন এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে, তার তথ্য ব্যাংকের কাছে চাওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোম্পানির পরিচালকদের প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও তথ্য চাইবে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানান, তিনটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের বেশিরভাগ পরিচালক চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ী পরিবারের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহ, এই পরিচালকরা নাবিল গ্রুপের সহজ শর্তে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ার সঙ্গে জড়িত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করে বলেন, ওই তিন ব্যাংক তাদের নিজস্ব নিয়ম লঙ্ঘন করে বিপুল ঋণ অনুমোদন করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকের অ-পারফর্মিং ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫১০ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এনপিএল ছিল ১ হাজার ৬২৮ দশমিক ৭৯ কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৮৫ দশমিক ১২ কোটি টাকা।

(সংগৃহীত)

Related Article