১৫ Jun ২০২৫
হোম স্বাস্থ্য সারাদেশ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি ও বাণিজ্য খেলাধুলা বিনোদন আন্তর্জাতিক ধর্ম ও জীবন লাইফ স্টাইল শিক্ষা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পরিবেশ চাকরি বা ক্যারিয়ার মতামত আইন-আদালত কৃষি ও প্রযুক্তি বিশেষ সংবাদ অপরাধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বকাপ ফুটবল
সাহিত্য ও সংস্কৃতি

ফেনীর মনজুর তাজিম দ্রোহ, প্রেম আর নিসর্গের কবি

১১ ডিসেম্বর, ২০২২

কামরুল আরেফিন,
ফেনী জেলা (ফেনী) প্রতিনিধি

ছবি: মনজুর তাজিমের সংগৃহীত ছবি।

নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন মনজুর তাজিমকে ভালোবেসে অভিহিত করেছিলেন “ প্রেমের কবি ” নামে। বিদগ্ধ পাঠকরা তাঁকে জানেন প্রেম ও প্রকৃতির কবি হিসেবে। ছিলেন বীর যোদ্ধাও। হৃদয়ে সযত্নে লালন করেন যুদ্ধ দিনের স্মৃতি। তাইতো তাঁর কোন কোন কবিতা রচিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধোর পটভূমিতে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেম ও প্রকৃতিকে উপজীব্য করেই অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কাব্য রচনা করে চলেছেন তিনি।

অনেক সময় একান্ত মনে হেঁটে চলেন কবি। দেখে হয়তো মনে হতে পারে- কোন কবিতার ছন্দ খুঁজে চলেছেন তিনি। শহরের এমন কোন ধূলোকনা নেই, যেখানে তাঁর পদচিহ্ন পড়েনি। প্রতিনিয়ত যেন নতুন নতুন কাব্যের জমিন আর মাল-মসলার সন্ধানে থাকেন প্রেম, দ্রোহ আর প্রকৃতির কবি মনজুর তাজিম।

তাঁর নাম ছিল আগা মনজুর তাজিম। প্রয়াত কবি হুমায়ুন কবির নান্টু-যিনি কবির হুমায়ুন নামে লিখতেন, তাঁর অনুরোধে ১৯৭৩ সালে “আগা” শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় ‘মনজুর তাজিম’। জন্ম নেত্রকোনার কেন্দুয়াতে, পিতার কর্মস্থলে ১৯৫২ সালের ৮ ডিসেম্বর। পিতা ফারুক আহমেদ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন । চার ভাই, চার বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। পৈত্রিক ভিটে ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর ইউনিয়নের বাংলাবাজারের দক্ষিণে হরিপুরে হলেও পিতা ঊনসত্তরের দিকে ফেনী শহরের উত্তর ডাক্তার পাড়ায় বসতি গড়েন সন্তানদেন পড়াশোনার সুবাদে। পিতা  ১৯৮২ সালে এবং মাতা ফেরদৌস আরা বেগম ২০১৯ সালে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

পিতার নানা জেলায় কর্মের সুবাদে কবিকে পড়তে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে। চাঁদপুর হাজীগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রথম পাঠ শুরু হয়। পরে হাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙামাটি মিশনারী স্কুল, রাঙামাটি শাহ উচ্চ বিদ্যালয়, রামগড় উচ্চ বিদ্যালয় ও কুমিল্লার ইশ্বর পাঠশালায় পড়ার সুযোগ পান তিনি। সত্তরে ফেনী পাইলট থেকে এসএসসি দেন। একাত্তরে ফেনী কলেজের বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র মনজুর তাজিমের হৃদয়েও ছুঁয়ে যায় আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের বারোতা। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি পরদিন ৮ মার্চ ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে মাইক বাজিয়ে শোনানো হয় অন্যতম সংগঠক খাজা আহমেদের নেতৃত্বে। মনজুর তাজিম যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। শুরতেই ফেনী সদরের সি.ও অফিস এলাকার প্রথম সম্মুখযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। এসময় তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন আব্দুল মোতালেব, সমীর কর, মানিকসহ আরো অনেকে। পরে তিনি পিতার পরামর্শে চট্টগ্রামে চলে যান- চাক্তাইয়ে তাঁর পিতার বন্ধু হাজী গিয়াস উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানে থেকে নানাভাবে কাজ করেন, স্থানীয় যোদ্ধাদের সহায়তা করেন। ১৬ ডিসেম্বর আবার ফিরে আসেন মুক্ত ফেনীতে। দেশ স্বাধীন হবার পর কবি চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ও পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলেও পিতার অনুরোধে ফেনী ফিরে আসেন এবং পঁচাত্তরে ফেনী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করেন।

কবির লেখালেখির জগৎ সুবিশাল। দেশের এমন কোন কাগজ নেই- যেখানে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়নি। ৮ম শ্রেনীতে পড়াকালে শুরু লেখালেখির। প্রথম লেখা ছাপা হয় ‘ইত্তেফাকে’ ‘কচিকাঁচার মেলা’ বিভাগে। পরবর্তীতে বহু কাগজে তাঁর গদ্য ও কবিতা প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন,  এরশাদ মজুমদার, গাজী রফিকের মতো কবিদের সান্নিধ্য পান। এনারাই তাঁর প্রিয় কবি। আরেক কবি ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রফিক রহমান ভুঁইয়ারও স্নেহধন্য তিনি। রফিক স্যার সবসময় তাঁকে উৎসাহ দিতেন, পরামর্শ দিতেন, প্রেরণা যোগাতেন। গত ২৫ বছর ধরে কবি প্রকাশ করছেন সাহিত্যের মাসিক কাগজ ‘আনন্দ ভৈরবী’। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘উল্টো দেয়ালে চুনকাম’ (২০০৭), ‘মাতাল মোহনার কাছাকাছি’ (২০১২), ‘উত্তরের জানালা’, ‘বুক পকেটে ভালোবাসা’, ‘এখনো ট্রিগারে আঙুল’, ‘অচিন কবির পদাবলী’, ‘বিকেলের ফুল’ (আরিফ রিজভীর সাথে যৌথ)। 
প্রকাশের অপেক্ষায় আছে ‘কাঞ্চিরে তুই কেমন আছিস’। তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতার সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।

লেখালেখির বাইরে নাট্য আন্দোলনের সাথেও যুক্ত কবি। ৮৪তে সারথীদের সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সুবচন আবৃত্তি ও নাট্য দল’। পরে ‘সুবচন’ নাটক নিয়ে কাজ করতে থাকে। ক্রিকেটের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। খেলতেন ‘ব্রাদার্সে’। পরে ‘ডিসেম্বর সিক্সটিন’ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে তার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় নাট্যজন সম্মাননা পান কুমিল্লা শিল্পকলায় এবং ফেনীতে পান শিল্পকলা সম্মাননা। বর্তমানে তিনি ‘ফেনী পোয়েট সোসাইটির সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ফেনী জেলার সিনিয়র সহ সভাপতি, ‘আলাপন আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রে’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রী বিফলা তাজিম, দুই ছেলে মনজুর আলিফ অপু, মনজুর আসিফ তপু ও নাতি মনজুর আজিল আরহামকে নিয়ে কবির সুখের সংসার। গত ৮ ডিসেম্বর কবির ৭১ তম জন্মদিন। 
তাঁর কবিতার দুটি চরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করব-

“বাংলা মায়ের সবুজ টিপ, মুহুরী নদীর ফেনী
জন্ম আমার এই মাটিতে, ধন্য চিরদিনই।”

Related Article